পাপুনের গোমড়া মুখ আজও সীতানাথ স্যারের নজর এড়ালো না। ছেলেটি যে খুব হাসিখুশি তা নয়, তবে তার মিষ্টি ব্যবহারের জন্য প্রথম দিন থেকেই সীতানাথের ভালো লেগেছে। পড়াশোনাতেও খুব একটা মেধাবী নয়, তবে মনোযোগী। সীতানাথের মনে হয় যত্ন নিয়ে পড়ালে ভালোই ফল করবে। অবশ্য তিনি সব ছাত্রের প্রতিই যত্নশীল। বেছে বেছে যে ভালো ছাত্রছাত্রীদের পড়ান তা তো নয়, সবার জন্যই তাঁর দুয়ার সবসময় খোলা থাকে।
তবে পাপুনের প্রতি স্যারের যে একটা আলাদা মনোভাব আছে, সবাই তা বুঝতে পারে।
"কী হয়েছে পাপুন? এনি প্রোবলেম?"
পাপুন চমকে তাকালো। স্যারের থেকে যে কোনকিছুই লুকোনোর উপায় নেই। কিন্তু পাপুন আজ কোনো কথাই বলতে পারল না। কী করে বলবে! একথা কি স্যারকে বলা যায়! হাজারবার বলা সত্ত্বেও বাবা যে কেন আসতে চাইছেন না, সেটাই সে বুঝতে পারছে না।
পাপুনের সায়েন্স নিয়ে পড়ার একদমই ইচ্ছে ছিল না। বাবাই তাকে একপ্রকার জোর করে সায়েন্সে ভর্তি করিয়েছেন। এ অঞ্চলে তারা নতুন।মায়ের সঙ্গে এখানে ভাড়াবাড়িতে থাকে। বাবা থাকেন গ্রামের বাড়িতে, মাঝেমধ্যে আসেন। স্কুলে ভর্তি হবার পর, টিউশন স্যারের খোঁজ করতেই সবাই একবাক্যে সীতানাথ স্যারের কথাই বলে দিয়েছিল। এই একমাসেই বুঝেছে, স্যার সত্যিই খুব ভালো পড়ান। অংকে তার বরাবরই ভয় ছিল। কিন্তু স্যার এতো সুন্দর করে বোঝান যে, এ কদিনে তার ভয় তো কেটেইছে, উপরন্তু অংকের প্রতি দারুণ আগ্রহও জন্মেছে। স্যারের কাছে যেই পড়তে আসুক না কেন, স্যার কাউকে ফেরান না। শুধু তিনি ফাঁকি সহ্য করতে পারেন না। আর একটাই শর্ত মাসের শেষে অভিভাবকরা এসে যোগাযোগ করে যাবেন। ছাত্রের হাত দিয়ে টাকা পাঠানো তিনি একদম পছন্দ করেন না। অবশ্য সেরকম অসুবিধা থাকলে কোনো কোনো স্টুডেন্টকে টাকা না নিয়েও পড়ান।
আজ মাসের শেষ। পড়া শেষে সব অভিভাবকেরা একে একে স্যারের সঙ্গে দেখা করে, যাচ্ছেন। ছেলেমেয়েরা কে কেমন পড়াশোনা করছে খোঁজখবর করছেন। সবার মুখই হাসিতে উজ্জ্বল। সাধারণের মধ্যে অসাধারণত্ব খুঁজে বের করা সীতানাথের যেন একটা নেশা, এতেই তাঁর আনন্দ। আস্তে আস্তে ঘর ফাঁকা হয়ে গেল। পাপুন তখনও চুপচাপ বসে। আজ বাবাকে সে বলে এসেছে, তিনি না এলে বাড়ি ফিরবে না।
"কী ব্যাপার তুমি বাড়ি যাবে না?"
স্যারের কথার উত্তরে পাপুন জোর করেই মুখে একটু হাসি আনল। "বাবা আসুক, তারপর যাব।"
খানিক বাদে পাপুনের বাবা এসে দাঁড়ালেন। এসেছেন অনেকক্ষণ আগেই। কিন্তু পা যেন সরছিল না। বাবা ও ছেলে দুজনের মুখেই এবার উজ্জ্বল হাসি দেখা গেল। সীতানাথ নামটা শুনে মনে মনে তাঁর সন্দেহ হয়েছিল ঠিকই, চোখে দেখে একেবারে তা পরিষ্কার হয়ে গেল। দেখতে একই আছে, সেই গাম্ভীর্য, বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা। শুধু বয়সের ছাপ পড়েছে। অনেক বছর তো হয়ে গেল।
সীতানাথ স্যারের মুখমণ্ডলে অবশ্য কোনো ভাবান্তর লক্ষ্য করা গেল না।
বললেন,"আরে অবনী যে! এদিকে কোথায়?"
অবনীবাবুর মুখে কোনো কথা সরল না। তিনি যে মরমে মরে আছেন।
পাপুন বলল,"স্যার, আমার বাবা।"
সীতানাথ স্যার হাতের ইশারায় তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,"আমি জানি। প্রথম দিন থেকেই আন্দাজ করেছিলাম। পাপুন যে চলাফেরা, চেহারায় ছোট অবনীরই সংস্করণ!"
অবনীর চোখ ছলছল হয়ে গেল। ও আমাকে এতোটা মনে রেখেছে!
সে কতদিন আগেকার কথা। সীতানাথ ও অবনী একসঙ্গেই পড়ত। অবনী অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে। আর সীতানাথ খুবই দুঃস্থ পরিবারের সন্তান। তবু দুজনের গলায় গলায় ভাব ছিল।সীতানাথের বইপত্র কেনা তো দূরের কথা দুবেলা ঠিকমতো খাওয়াদাওয়াই জুটতো না। প্রথম প্রথম এরওর থেকে চেয়েচিন্তে কোনরকমে চলত। অবনীও কমবেশি সাহায্য করতো। তবুও পরিস্থিতি এমন হলো, যে উঁচু ক্লাসে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়ে উঠল।
স্কুলে রাধেশ্যাম স্যার অনেক তদারকি করে কী একটা ব্যবস্থা করে দিলেন, যার ফলে সে তপশীলি জাতির অন্তর্ভুক্ত ছাত্রছাত্রীরা যে সব সুযোগ সুবিধা পায়, তার সবটুকুই তিনি পেলেন। কিন্তু তখন অতটা জানতেন না যে এটা আইনের চোখে অপরাধ। পরে রাধেশ্যাম স্যারকে সেটা বলতেই তিনি বলছিলেন,"তুই থামতো, কতজন তাদের সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও এই ভাবে সুযোগ সুবিধা নিয়ে যাচ্ছে। আর তোর মতো একজন মেধাবী ছাত্র শুধু পয়সার অভাবে পড়াশোনাটা বন্ধ হয়ে যাবে! এ আমি কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারছি না। আইনের চোখে হয়তো আমি অপরাধ করেছি, কিন্তু ভগবান জানেন আমি একটা পূণ্যের কাজই করেছি। তাই আমার কোনো অপরাধবোধ নেই। তাছাড়া খেয়েদেয়ে কারও কাজ নেই যে এসবের খোঁজ নিতে যাবে। তুই খালি মন দিয়ে পড়াশোনাটা করে যা।"
সেই শুরু, তারপর একে একে স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটির গন্ডি কৃতিত্বের সঙ্গে পার করে এসেছেন। অবনীও পড়াশোনায় ভালো, কিন্তু সীতানাথের মতো অতোটা নয়। দুজনে অভিন্ন হৃদয়ের বন্ধু হলেও মনে মনে অবনী সীতানাথকে হিংসেই করতেন। তাই কলেজের চাকরিটা ওর না হয়ে যখন সীতানাথের হলো তিনি আর সহ্য করতে পারেননি।
কী করে যেন ওপর মহলে লিখিতভাবে খবরটা ঠিক পৌঁছে গেল। কলেজে জয়েন করার কিছুদিনের মধ্যে তার নামে একটি নির্দেশিকা এল যে, তিনি সংবিধানের বিধি ভঙ্গের মতো অপরাধ করেছেন। শাস্তি স্বরূপ তাঁর সমস্ত ডিগ্রী আজ থেকে বাজেয়াপ্ত করা হল।
কোনরকম অনুরোধ উপরোধ করেও কোনো লাভ হলো না। সীতানাথকে চরম অসম্মানের বোঝা মাথায় নিয়ে কলেজ থেকে বেরিয়ে আসতে হলো।
এর কয়েকদিনের মধ্যে সবাই জানল যে, সীতানাথ নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। সীতানাথকে গ্রামের সবাই ভালোই বাসতো। কে যে ওর এই সর্বনাশ করল সবাই এই জল্পনাতেই কদিন তারা মেতে রইল। তারপর যা হয় আরকি। আস্তে আস্তে সীতানাথের কথা সবার মন থেকে একসময় মুছে গেল।
সীতানাথ কদিন ভ্রাম্যমাণের মতো এখানে সেখানে ঘুরে শেষ পর্যন্ত অশোকনগর নামক এই শহরতলি অঞ্চলে থিতু হয়। তার সব ডিগ্রী বাজেয়াপ্ত হলেও কঠোর পড়াশোনা দ্বারা যে বিদ্যাশিক্ষা অর্জন করেছিলেন, তা তার অন্তরে মণি মানিক্যের মতো সদা দীপ্যমান হয়ে রয়ে গেছিল। যা নেভানোর ক্ষমতা কারোও ছিল না। তাঁর সংস্পর্শে আসতেই এই এলাকার বাসিন্দারা খুব তাড়াতাড়িই সেটা টের পেয়েছিলেন।
সেই শুরু, এভাবেই ছাত্রছাত্রী পড়িয়ে তিনি এ অঞ্চলের সবার প্রিয় শ্রদ্ধেয় সীতানাথ স্যার হয়ে উঠেছিলেন।
অবনী বললেন,"তুই আমাকে ক্ষমা..."
সীতানাথ অবনীকে থামিয়ে দিলেন,"ওসব কথা এখন থাক অবনী, কী লাভ!"
অবনীও ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে গেলেন।
সীতানাথ আবার বলল,"পুরোনো কথা আমি ভুলে গিয়েছি রে। বেশ আছি। জানিস দেশে বিদেশে আমার কত ভালো ভালো ছাত্রছাত্রী আছে? তাঁরা সবাই হায়ার পোস্টে চাকরি করছে। এখনও আমার খোঁজখবর রাখে, আমায় কত ভালোবাসে, সম্মান করে। আমার কোনো দুঃখ নেই রে।" মনে মনে ভাবলেন, তাঁর অবস্থার জন্য কাকে কাকে তিনি দায়ী করবেন, অবনী না দেশের আইন কানুন না সংবিধানের বিধিব্যবস্থা না রাধেশ্যাম স্যারকে, তিনি তো ভালোই করতে চেয়েছিলেন। আজ যতটুকু বিদ্যাবুদ্ধি ছেলেমেয়েগুলোর মধ্যে বিলিয়ে দিতে তিনি পারছেন, এতো তাঁরই কল্যাণে। এটুকুই বা কম কি! ঈশ্বর এটুকু অন্তত তার কপালে লিখেছেন। সেইজন্য তার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।"
অবনী আর কোনো কথা বলতে পারলেন না। দুএকটা কুশলবার্তা বিনিময়ের পর ওরা বাড়ির পথে হাঁটা দিল। পাপুনের আজ খুব আনন্দ! এতোদিন তার পড়াশোনার ব্যাপারে একমাত্র মা সবজায়গায় যেতেন। বাবা কোনো খোঁজ খবরই রাখতেন না। আজ বাবা এসেছেন! তাছাড়া স্যার বাবার সহপাঠী জেনে খুব ভালো লাগল।
"জানো বাবা স্যার এত ভালো পড়ান, সবাই তো মন্ত্রমুগ্ধের মতো বসে থাকে। আমি তো এর মধ্যে অনেক কিছুই তাড়াতাড়ি শিখে গেছি। আর সবাই কি বলে জানো! স্যার এতো ব্রিলিয়ান্ট যে, স্কুলে তো বটেই, কলেজের প্রোফেসর হওয়া উচিত ছিল। তাহলে আরও কত ছেলেমেয়েরা ওনার কাছে পড়ার সুযোগ পেতো। কেন যে স্যার কোনো চাকরি না করে শুধু টিউশন পড়ান, বুঝতে পারি না।"
এর উত্তরটা তো অবনীর জানা, কিন্তু সে কি বলতে পারবে, এর জন্য সেই দায়ী। আজ অবনী দেখলো তার ছেলে পাপুনের মুখে শুধু সীতানাথের প্রশংসার ফুলঝুরি। সত্যিটা যদি পাপুন জানতে পারে তাহলে সে কি তাকে আর শ্রদ্ধার চোখে দেখবে? আর সীতানাথ,তাঁর মতো বন্ধু সত্যিই দুর্লভ। ভগবান জানেন কী পাপ তিনি করেছেন।
অবনীর মন অনুতাপের আগুনে পুড়ে দগ্ধ হতে লাগল।
একসময় মনে হিংসা থেকে তিনি একাজ করেছেন বটে, কিন্তু বিগত বছরগুলোতে মনে এতটুকু শান্তি পান নি। সীতানাথ এর কতটুকু জানেন তিনি জানেন না। তবে মনে মনে ঠিক করলেন, এরপর একদিন একা এসে সীতানাথের কাছে সবকিছু বলে ক্ষমা চাইবেন। না হলে তার মন শান্ত হবে না। সব জেনে সীতানাথ কি তাকে ক্ষমা করবে? নিশ্চয় করবে, সে যে বড় মনের মানুষ।
